স্বদেশ ডেস্ক:
অর্থপাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশন লিমিটেডের বিরুদ্ধে করা দুই মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ নয় বছরে। হাইকোর্টও এ দুটি মামলার বিচারে ধীরগতিতে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মামলা দুটির বিচার শেষ করতে একাধিকবার সময় বেঁধে দিয়েছেন।
এ ছাড়া দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলা আমলে নেওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ‘দ্য ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮’-এ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এ বিধান পালনে বিশেষ জজ আদালতগুলোর প্রতি নির্দেশনা দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সার্কুলার জারি রয়েছে। কিন্তু আইনের বিধান বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কোনোটাই যেন কাজে আসছে না। শুধু এ দুটি দুর্নীতির মামলার বিচারের ক্ষেত্রেই নয়, দুদকের করা অন্য মামলার ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
জানতে চাওয়া হলে দুদকের সুপ্রিমকোর্ট ইউনিটের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আমাদের সময়কে বলেন, ডেসটিনির একটি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি রয়েছে। অন্য মামলায় পাঁচ-ছয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় এখন
বিচার বন্ধ রয়েছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার আগেই নিম্ন আদালতের পক্ষ থেকে সময় চেয়ে আবেদন করা হলে হাইকোর্ট আরও ছয় মাস বৃদ্ধি করেন। আশা করছি করোনাকাল পার হওয়ার পর বিচারকাজ শুরু হলে দ্রুতই এ মামলার বিচার শেষ হবে।
নিম্ন আদালতে এ মামলা পরিচালনাকারী দুদকের আইনজীবী বিশেষ পিপি মীর আহম্মেদ আলী সালাম আমাদের সময়কে বলেন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলা একেবারেই শেষ পর্যায়ে। শুধু আইওর সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি রয়েছে। করোনা না এলে গত বছরই মামলাটির বিচার শেষ হয়ে যেত। বিলম্বের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মামলায় প্রায় ৩০০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এত বেশিসংখ্যক সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে গিয়ে মামলার বিলম্ব হয়েছে। ট্রি-প্ল্যানটেশনের মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলাটি শেষ হলেই অন্যটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২০১২ সালের ৩১ জুলাই মামলা দুটি করে। ২০১৪ সালের ৪ মে একটি মামলায় ১৯ জনের এবং অন্য মামলায় ৪৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। রফিকুল আমীনসহ ১২ জনের নাম দুটি মামলায়ই রয়েছে। সে হিসাবে দুই মামলায় মোট আসামি ৫৩ জন। ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং এর মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। এর পর দীর্ঘদিনেও মামলা দুটির অভিযোগ গঠন না হওয়ায় হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে ২০১৬ সালে অভিযোগ গঠনের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। পরে হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট দুটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। সেই থেকে বিচার চলছে। এ মামলার বেশিরভাগ আসামিই এখনো পলাতক।
অভিযোগ গঠনের পর দুদকের আইনজীবী মীর আহম্মেদ আলী সালাম জানিয়েছিলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০৯-এর ৪(২) এবং ২০১২-এর ৪-এর (২ ও ৩) ধারায় দুটি মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা যাবে। তবে শাস্তির মেয়াদ চার বছরের কম হবে না। এ ছাড়া আসামির সাজার পাশাপাশি তার পাচার করা অর্থ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন আদালত।
এদিকে মামলা দুটির আসামি ডেসটিনি গ্রুপের এমডি রফিকুল আমীন, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, পরিচালক দিদারুল আলমসহ কারাবন্দি কয়েকজন বছরের পর বছর কারাগারে রয়েছেন। তারা যে সাজা পাবেন আদালত থেকে তা ইতোমধ্যে প্রায় ভোগ হয়ে গেছে। এ কারণে আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানিকালে মামলার বিচার শেষ না হওয়ায় হাইকোর্টও একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট হাইকোর্ট এক আদেশে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অর্থপাচারের মামলাটি এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে মামলার বিচার শেষ না হওয়ায় ২০১৮ সালের ২৪ জুন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক (বিশেষ আদালত ৫-এর বিচারক) সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি আবেদন পাঠান। এতে এক বছরের সময় চাওয়া হয়। এ অবস্থায় হাইকোর্ট সময় বেঁধে দিয়ে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিলের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট বিচারককে নির্দেশ দেন। এর পর এ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আবার সময় চেয়ে আবেদন করলে হাইকোর্ট ছয় মাস সময় দেন। সেই ছয় মাসও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মামলার বিচার শেষ হয়নি।
এদিকে গত বছরের ২০ আগস্ট হাইকোর্ট ডেসটিনির দুই মামলায় রফিকুল আমীনের জামিন আবেদন খারিজ করে দুই মামলা বিচারিক আদালতে ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে আদেশ দেন। সেই ছয় মাসও পার হয়ে গেছে। কিন্তু বিচার শেষ হয়নি। এদিকে ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। তখনকার হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের অধীনে আনা দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালত গঠন করা হয় এবং ওই আদালতগুলোয় দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলা আমলে নেওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ‘দ্য ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮’-এ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, অধিকাংশ জেলার দায়রা ও মহানগর দায়রা জজরা দুর্নীতির মামলা বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতে না পাঠিয়ে নিজ আদালতে রাখেন বা তার অধীনস্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ও যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে পাঠান। ফলে বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতগুলোয় দুর্নীতি মামলার স্বল্পতা ঘটে। বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতগুলোর দুর্নীতির মামলা আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এবং কাক্সিক্ষত হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সব জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজকে দুর্নীতির মামলাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো এবং ওই আদালতগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হলো।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা থাকলে বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কমে যায়। ডেসটিনির মামলায় এই যে বিলম্ব, এ জন্য দায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুদক। তাদের কাজ ছিল মামলা দ্রুত রায়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের গাফিলতির জন্যই মামলার চূড়ান্ত রায় হতে দেরি হচ্ছে।’